"খাই খাই করো কেনএ
সে বসো আহারে,
খাওয়াবো আজব খাওয়া
ভোজ কয় যাহারে"-
সুকুমার রায়ের খাওয়া দাওয়ার মহা ভোজ নিয়ে এই কবিতার যথার্থ মানে বোধহয় একমাত্র বিয়ে বাড়িতে গেলেই পাওয়া যায়।ভিন্ন ধারার স্টল,স্টার্টার,মেইন কোর্স আহা সব মিলে এক এলাহি আয়োজন।যদিও পেটরোগা বাঙালি আদৌ কতটা এখন খেতে পারে বিয়েবাড়িতে বসে তাও বেশ প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার।আমাদের প্রজন্মের সকলেই বোধহয় একটা কথা বাপ ঠাকুরদার মুখে প্রায়ই শুনেছি যে ''বিয়ে বাড়িতে খাওয়া ছিল আমাদের সময়"-ঠিক বালতি উপুর করে কিলো কিলো মাংস,শ'য়ে শ'য়ে মিষ্টি সব নাকি তাঁরা সাবার করে দিত এক লহমায়।আমরা বর্তমান লাইফ স্টাইলে এসব কল্পনাও করতে পারি না।সত্যিই বদলে গেছে বিয়েবাড়ির রীতি রেওয়াজ সাথে খাওয়া দাওয়ার ধরনও।তাই আমরা 'খাইবারপাসে' আজ থেকে শুরু করতে চলেছি বাঙালি বিয়ে বাড়ির খাবারের ইতিহাস ও তার প্রত্যাবর্তন। আর্য সময় থেকে শুরু করে বর্তমানের ক্যাটারিং যুগের হাত ধরে থিম বিয়ে-সবটা নিয়েই আপনাদের স্বাদ দেবো আপনাদের বিয়ে বাড়ির খাওয়ারের।বাবুয়ানা থেকে সাবেকিয়ানা বা হাল আমলের ফ্যাশনবেল খাওয়া সবটা পড়ে আপনারা নস্টালজিয়াতে হারিয়ে যাবেন এবিষয়ে সন্দেহ নেই।তাহলে আর দেরী কিসের,চলুন আজ প্রথমেই পাত পেরে বসি সেই পুরনো আমলের বিয়ে বাড়ির মেনুর সাথে।
বাঙালি বিশেষ করে হিন্দু বিবাহ হয় বৈদিক মন্ত্র উচ্চারন করে।আর্য সভ্যতায়ও বিভিন্ন ধরনের ভোজের উল্লেখ পাওয়া যায়।সেই সময় সাধারণত একটি পূর্ণবয়স্ক গরু মেরে তার মাংস রান্না করে মধুপর্কের সংগে দেওয়া হত।কি চমকে গেলেন তো হিন্দু বিয়েতে গরু খাওয়ানোর কথা শুনে? হ্যাঁ মশাই! প্রাচীন কালে হিন্দু ভোজে গরু খাওয়ানোর রেওয়াজ ছিল।রাজারাজরা যঞ্জের জন্য প্রচুর পরিমানে গো হত্যা করতেন এবং সেই মাংস বিলিয়ে দিতেন।তবে গরুর সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে থাকায় পরবর্তীতে অতিথি সেবার জন্য গরু আনা হলেও তাকে না মেরে ছেড়ে দেওয়া হত।বিবাহ অনুষ্ঠানে ঋক্ বেদের ৮/১০১ সুক্ত অনুসারে গরুকে না মেরে বিবাহ মন্ডবে গরুকে বেঁধে রাখা হয়,যা আজও অনেক হিন্দু বিবাহ অনুষ্ঠানে দেখা যায়।
১৮০০ সালের পূর্বে বাংলার বিশেষত হিন্দু বিবাহের যে বিবরণ বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্হে পাওয়া যায় তা থেকে জানা যায় সেই সময় অনুষ্ঠান বাড়িতে রান্না করা খাবারের প্রচলন সেভাবে ছিল না।ব্রাহ্মন বা অব্রাহ্মন যে বাড়িতেই বিয়ে হোক না কেনো ব্রাহ্মন ভোজন ছিল অন্যতম প্রচলিত রেওয়াজ।তবে ব্রাহ্মনকে রান্না করে খাওয়ার না খাইয়ে দেওয়া হত সিধা, যা আসলে মাটির সরায় বা কাঁসা,তামার পাত্রে -আতপ চাল,ডাল,স্বব্জি,চিড়ে,মুড়কি,ফল,বাতাসা,সর্ষের তেল ও রান্নার বিভিন্ন মশলা তুলে দেওয়ার প্রথা।সেই সাথে দেওয়া হত নতন কাপড় ও দক্ষিনা।আসলে ব্রাহ্মনরা সেই সময় অন্যের হাতের রান্না গ্রহন না করায় এই ব্যবস্হা নেওয়া হয়েছিল।বহু বড়লোক গৃহকর্তার বাড়ির অনুষ্ঠানে 'সিধা' নেওয়ার জন্য দূরদূরান্ত গ্রামের ব্রাহ্মনদের লাইন পড়তো।এবার 'সিধার' উপকরণ বা দক্ষিনার পরিমাণের উপর নির্ভর করতো গৃহকর্তার মর্যাদা।এছাড়াও গরীব দুঃখি দিন দরিদ্রদের জন্য থাকতো খাওয়া ও অন্যান্য ব্যবস্হা। বিয়ে উপলক্ষে এই গরীবদের দান করা হত চাল,ডাল, কাপড় ইত্যাদি।আর নিজেদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু স্হানীয় লোকেদের জন্য থাকতো বাড়ির মা বোনেদের হাতে রান্না করা খাবার-যার মধ্যে অন্ন,বিভিন্ন স্বব্জি,মন্ডা,বাতাসা, ইত্যাদি।
এবার আসা যাক ১৮০০ সাল অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর বিয়ের ভোজের কথায়।এই সময়ের পুরোভাগে অর্থাৎ প্রায় ১৮৭০ সাল নাগাদ পর্যন্ত বিবাহের প্রধান ভোজ হিসেবে থাকতো ফলাহার।যার প্রধান উপকরন ছিল দই,চিড়ে,ঘি,কাঠালি কলা,আম,বাতাসা,মন্ডা ইত্যাদি।সেই সময়ের ব্রাহ্মনেরা অন্য জাতের রান্না করা খাবার না খেলেও বিবাহ অনুষ্ঠানে বসেই মূলত ফলাহার করতো।মরশুমি ফল এবং তার পরিমান ও উৎকৃষ্ট দধির উপর নির্ভর করতো গৃহস্থের মান মর্যাদা।বরযাত্রীদের জন্য থাকতো বিশেষ ধরনের মিষ্টি।যদিও তা ছানা থেকে তৈরি হওয়া মিষ্টি নয়,তৈরি হত প্রধানত ময়দা,দুধ ও বাতাসা দিয়ে।যদিও এই সময়ও বেশ কিছু বড়লোক বাঙালির বাড়ির বিয়েতে প্রচলিত নিয়ম বর্হিভূত ভাবে নিরামিষ খাবারের ব্যবহারও শুরু হয়েছিল।
১৮৭০ সাল নাগাদ বাংলায় ময়দার প্রচলন শুরু হয় এবং সেই সাথেই পরিবর্তিত হয় বিয়ে বাড়ির মেনু।বড় বড় ময়দার লুচি সাথে আলুনি কুমড়োর ছক্কা পরিবেশিত হতে থাকে।মনে করা হত খাওয়ারে নুন ব্যবহার না করলে সেই খাবার এটো হয় না।তাই আলুনি বা নুন ছাড়া ছক্কা ব্রাহ্মন ও অব্রাহ্মন সকলেই গ্রহন করতে পারতো।এর পরবর্তী সময়ে বাংলায় বিলাতি কুমড়া নামে এক স্বব্জি প্রচলিত হওয়ায় বহু ধনী বাড়িতে বিয়েতে বিলাতি কুমড়ার ঘন্ট লুচির সাথে পরিবেশন করা হত।আবার এসময় থেকেই অল্প অল্প করে বাংলায় বাঁধাকপির প্রচলন শুরু হওয়ায় কুমড়োর সাথেই মেনুতে যোগ হতে থাকলো বাঁধাকপির ঘন্ট।লুচি ও ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে কচুরির রূপ নেয়।কলাইয়ের ডাল বাটা,আঁদা,মৌরি সহযোগে ময়দার ভেতরে পুর হিসেবে ব্যবহার করে তৈরি হওয়া কচুরি পরিবেশন হত বড় বড় মাটির সরায়।বড়সড় আকারের এই কচুরি কর্মবাড়ির কচুরি নামে লোকমুখে প্রচারিত হতে থাকে।সরার মধ্যে কচুরির সাথে থাকতো নিমকি,মতিচুর,খাজা,চারকোনা আকারের গজা ইত্যাদি।শেষপাতে আসতো দই ও ক্ষীর।
১৮৭৩-৭৪ সাল নাগাদ রসগোল্লার প্রচলন বৃদ্ধি পাওয়ায় বিয়ে বাড়িতে প্রথম রসগোল্লা মেনুতে জায়গা নিতে থাকে।রসগোল্লার সাথে অন্য মিষ্টি হিসেবে দেওয়া হত তিলকুট ও বিভিন্ন ধরনের সন্দেশ।যার মধ্যে আম সন্দেশ,কামরাঙা সন্দেশ,কড়া পাঁকের সন্দেশ ছাড়াও পরিবেশিত হত বাংলার প্রথম ব্যন্ডেড সন্দেশ গুপো।
ইংরেজি শিক্ষার প্রচলনের সাথে সাথে বিয়ে বাড়ির ভোজের খাবারেও বিশাল পরিবর্তন আসে।খাওয়ারে নুনের ব্যবহার শুরু হয়।কুমড়োর ছক্কার জায়গা নেয় ছোলার ডাল ও আলুর দম।কচুরির সাথে যাদের যুগলবন্দী এখনো বাঙালির প্রিয়।এর সংগে আর একটি খাওয়ার লুচির সাথে বিয়ে বাড়িতে পরিবেশিত হওয়া শুরু হয়,যা এখন ভাবলে অবাক লাগে,তা হল শাক ভাজা।বাদাম সহযোগে তৈরি এই শাকভাজা লুচি বা কচুরির সাথে বিয়ে বাড়ির অন্যতম পরিচিত খাবার হিসেবে জায়গা নিতে থাকলো।
এই শতকের শেষ দিকেই বিয়ে বাড়ির খাবারের লিস্টে যোগ হয় চাটনি সাথে পাপর।এভাবেই ঊনবিংশ শতকের বিয়ে বাড়ি গুলোতে আমিষ খাবারের প্রবেশ না হয়ে বেশ জাঁকজমক ভাবেই পরিবর্তিত হতে হতে নিরামিষ খাবারই জায়গা করে নেয় মেনুতে।
(প্রথম পর্ব শেষ, আসবে দ্বিতীয় পর্ব)
অসাধারণ লেখা দাদা, পুরোপুরি গবেষণালব্ধ ফসল। আমি আগেও অনেকের মুখে শুনেছি যে বৈদিক যুগে আর্যরা নাকি গোমাংস খেতে, তবে আমার একটা প্রশ্ন আছে?
উত্তরমুছুনঋকবেদে গরুকে "অঘ্ন" বলা হয়েছে, অর্থ যাকে হত্যা করা যায় না। তাহলে তো গো মাংস খাওয়ার ব্যাপারটা পুরোপুরি মিলছে না।
অসাধারণ লেখা
উত্তরমুছুনভীষণ ভালো 👏🏻
উত্তরমুছুনঅনেকটা ইতিহাস জানতে পারবো বলে আশা রাখছি।
উত্তরমুছুনBha onek kichu Jana gelo
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো৷ গল্পটা পড়ে ।
উত্তরমুছুনজাস্ট অসাধারণ
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন