দুলাল চন্দ্র ভড়ের তালমিছরির গল্প। লিখেছেন অভ্রনীল রায়

 নিজের বিশ্বাসে 'ভড়' করেই 'দুলাল' আজও স্বমহিমায়!

বাঙালির বরাবরই ব্যবসা শুরু করতে অনিহা। নিঝঞ্ঝাট থাকা বাঙালি কেরানি বাবু হয়েই দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিতে পারে।আজও এর অন্যথা হয় নি।বর্তমানে চাকুরির বেহাল দশা যখন বেকারত্বের মান দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে তখনও হন্যে হয়ে পড়ে থাকতে হয় কবে একটা 'চাকুরি' পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যাবে।কারন ওই যে, বাঙালি ব্যবসার ঝুঁকি নিতে যে বড় ভয় পায়!এরকম ট্যাগ যখন আমার আপনার মত বাঙালির গায়ে সেটে আছে,এরকম এক অবস্থায় আজ শোনাবো আপনাদের এক ঊনিশ বছরের ছেলের সাহস করে তৈরি করা এক ব্যবসার কথা।যা ৮০ বছর ধরে বাঙালির ঘরে ঘরে ডাক্তারি প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বহু রোগ নিরাময় করে যাচ্ছে বেশ নিঃশব্দেই।

নিজের বিশ্বাসে 'ভড়' করেই 'দুলাল' আজও স্বমহিমায় - লিখেছেন অভ্রনীল রায়

আমাদের বিষয়ে ঢুকতে গেলে ফিরে যেতে হবে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে।হাওড়ায় তখন জহরলাল ভড়ের কাপরের একচেটিয়া কারবার।হাওড়া হাটে কাপরের তাদের পারিবারিক সূত্রে বহু দোকান।জহরলাল বাবুর ছেলেরা,নাতিরাও এই ব্যবসায় নেমে পড়েছে।নিশ্বাস ফেলার সময় টুকু নেই।তবে পারিবারিক সূত্রে পাওয়া এই ব্যবসায় নামতে বেঁকে বসল জহরবাবুর নাতি বছর ঊনিশের দুলাল চন্দ্র ভড়


কি এই 'দুলাল চন্দ্র ভড়' নামটা শুনতেই মনে পরে গেলো না টিভির বিঞ্জাপনে হওয়া সেই ঐতিহ্যবাহী বিঞ্জাপনের লাইন -'দুলাল চন্দ্র ভড়ের তালমিছড়ি, সই ও ছবি দেখে তবেই কিনবেন'! 


এই না হ'ল বাঙালির স্মৃতিশক্তি।আর যিনি বাঙালিকে দীর্ঘ এতগুলো বছর ধরে সর্দি, কাশি, গলা খুশখুশ কমিয়ে স্মৃতি শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে যাচ্ছেন তিনিই হলেন দুলাল চন্দ্র ভড়,আর তার তৈরি প্রোডাক্ট তালমিছরি যা ভারত, বাংলাদেশ ছেড়ে বিদেশেও পাড়ি দিয়ে একচেটিয়া কারবার করে যাচ্ছে আজও।


তবে শুরুটা এতটা সহজ ছিল না দুলাল চন্দ্রের।পারিবারিক চাপে তাকে অল্প বয়স থেকেই কাপড়ের ব্যবসা দেখতে হচ্ছিল।কিন্তু সেই অল্প বয়সেই তিনি চাইছিলেন নিজের মত কিছু একটা ব্যবসা শুরু করতে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই সময়টায় মিছরির খুব ডিমান্ড ছিল ঘরে ঘরে।চিনির বদলে মিছরি দিয়ে সরবত খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে তাই তার চল ছিল তখন বেশ।তাছাড়া বাঙালি ঘরে পূজাপার্বণেও ঠাকুরের প্রসাদ হিসেবে মিছরি তো চলতই।তাই দুলাল একদিন হঠাৎ করেই ঠিক করলেন মিছরির ব্যবসা করবেন।সেই মত শুরুও হল।মোটামুটি ব্যবসা চললেও খুব একটা লাভ করতে পারছিলেন না তিনি।কারন তখন ইতিমধ্যেই অনেকেই মিছরি বিক্রি করা শুরু করেছিল তাই তাদের সাথে ঠিক মত জুত করতে পারছিলেন না দুলাল চন্দ্র।এছাড়া তিনি চাইছিলেন নিজস্ব কোনো প্রোডাক্ট, যা তিনি ছাড়া আর কেউ করবে না।এদিকে দুম করে মিছরির ব্যবসাও ছেড়ে দেওয়া যায় না,কারন ততদিনে এই ব্যবসার কিছু পরিচিতি তিনি করে ফেলেছিলেন।তখনই তার মাথায় আসে তাল মিছরির ভাবনা।ব্যাস,সেই তালমিছরি যা এখনো একচেটিয়া কারবার করে যাচ্ছে বিশ্বজোড়া বাঙালির কাছে।


শুরু হল,মিছরির জায়গায় তাল মিছরির তৈরির প্রক্রিয়া,যা তিনি নিজেই করেছিলেন বলে জানা যায়।প্রথমে তালের গুড় কিনে তা ভালো করে জ্বাল দিয়ে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় তা নিয়ে যেতে লাগলেন।তারপর ফুটন্ত গরম অবস্থায় থাকা গুড় ঢালা হ'ত বড় বড় ট্রে তে।তারপর বিশেষ ধরনের চটের কাপর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হত ট্রের মুখ।এরপর বন্ধ ঘরে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় তা ওইভাবেই রেখে দেওয়া হত একসপ্তাহ মত।এই পাক ও মিশ্রন ঠিক ঠাক হলে ট্রের উপরের অংশে জমাট বাধতো পুরু আকারের মিশরি।সেগুলোকে কাটিং করে প্যাকিং করে বিভিন্ন মাপের বস্তায় ভরে রপ্তানি করা শুরু হল গোটা বাংলা সহ,পূর্ব বঙ্গেও। তালের খাটি রস আর সামান্য চিনি মিশ্রিত এই দ্রব্যই কোনো ব্রান্ডঅ্যাম্বাসেডর বা সেলসম্যান ছাড়াই হয়ে উঠতে লাগলো নিজেই এক আস্ত বিঞ্জাপন।ক্রমশ এর ব্যাপ্তি ভারত,বাংলাদেশ ছেড়ে বিশ্বের দরবরেও পৌঁছে গেলো।


দুলাল চন্দ্র বরাবরই চাইতেন নিজস্ব ব্র্যান্ড,যেখানে থাকবে শুধু তাঁর একচ্ছত্র অধিকার।তাই ব্যবসা যখন বছরখানেকের মধ্যে দৌঁড়তে লাগলো,তখন তিনি ইংরেজদের সাহায্যে ১৯৪৪ সালে পেয়ে গেলেন তাঁর তৈরি তালমিছরির জন্য 'রেজিস্ট্রেশন নম্বর'ও। 

আজও মাঝারি মাপের কাঁচের বয়ামে ক্লিন সেভের,মিষ্টি হাসি,সামান্য ঘাড় বাঁকানো,চওড়া কপালের বাঙালি ভদ্রলোক দুলাল চন্দ্রের ছবির ঠিক নীচেই লেবেলের উপর ৩৯৬৫ রেজিস্ট্রেশন নম্বরটি যেন একই রকম প্রাসংগিক।


নিজের তৈরি ব্যবসাকে উচ্চস্হানে নিয়ে যাওয়া খাটি বাঙালি দুলাল চন্দ্র ২০০০ সালেই ইহ জগত ত্যাগ করেন।কিন্তু তারপরেও এক ও অদ্বিতীয় ব্রান্ড হিসেবে এখনো ইহা এক নম্বরে,শুধুমাত্র দ্রব্যের গুনমানের জন্য। বর্তমানে এই ব্র্যান্ডের সাথে যুক্ত দুলালবাবুর উত্তরসূরীরা এখনো শুধুমাত্র তমলুক থেকে আনা তালের গুড় ছাড়া মিছরি তৈরি করেন না,এবং এর সাথে যুক্ত কর্মচারীরাও বংশনাক্রমেই এই কাজের সাথে যুক্ত।পাশাপাশি, একটা মজার তথ্যও বলে রাখা দরকার, এই প্রোডাক্ট এতটাই বাঙালিয়ানা বহন করে যে ১৯৭৬ সালের হিট হিন্দি সিনেমা 'দো আনজানে' তে অভিনেত্রী রেখার ফ্ল্যাটটিকে বাঙালি বাড়ি বোঝাতে পরিচালক 'দুলাল গুহ' সেটের তাকে দুলাল চন্দ্র ভড়ের তালমিছরির একটি শিশি রেখেছিলেন, কারন বাঙালির ঘরে ঘরে তখন এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। তাহলেই বুঝুন এর মাহাত্ম্য! 


দুলালচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর পারিবারিক ব্যবসার অংশীদার নিয়ে বহু মামলা মোকদ্দমা হয়েছে,এই মামলায় কেস লড়েছিলেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ও,যে কারনে মিমাংসা না হওয়ায় ২০০৩-২০০৫ সাল পর্যন্ত দুলাল চন্দ্র ভড়ের তালমিছরির সব রকম উৎপাদন ও বিঞ্জাপনও বন্ধ ছিল।


এত সব ঝড় ঝাপটা,লড়াই এর পরেও বাঙালির ঘরে ঘরে জায়গা করে নিতে পেরেছিল এক যুবকের অসম সাহসী সিদ্ধান্ত ও নিজের উপর বিশ্বাস।যার ফলে জীবদ্দশায় তো বটেই, মৃত্যুর এত বছর পরেও দুলাল চন্দ্র ভড় যেনো বেঁচে আছে আজও তার প্রিয় দ্রব্য 'তালমিছরির' মধ্য দিয়ে।

11 মন্তব্যসমূহ

  1. 😋 ৮০ দশক ধরে বাঙালির ঘরে ঘরে
    দুলালের তাল মিছরি , খাও প্রাণ ভরে 😁🤟
    দারুন দারুন লেখা অভ্র 🥰
    ফ্যান 😍

    উত্তরমুছুন
  2. কিছুটা জানতাম
    তবে আজ আরও বেশি জানলাম♥️

    উত্তরমুছুন
  3. এতো আর আলালের ঘরে দুলাল নয় তাই পরিশ্রমের ফসল বাঙালির ঘরে ঘরে আজ ও দুলাল চন্দ্র ভড়ের তালমিছরি...😊

    উত্তরমুছুন
  4. অনেক জানলাম।আর সত্যিই একচেটিয়া

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন