সিলসিলা নয়, 'সিঙারা'-একটি ত্রিকোন প্রেমের গল্প!
৮০'এর দশকে এক সারা জাগানো বলিউড সিনেমা সিলসিলা, যেখানে অমিতাভ বচ্চন, জয়া ভাদূরি ও রেখা-এই তিনজনের একসাথে অভিনয়ে একটি সাধারণ ত্রিকোন প্রেমের গল্প ই দর্শকের কাছে হয়ে উঠেছিল যেন 'মুখরোচক খাবার'। তারআগে ও পরেও বহু 'ট্রাই অ্যাঙ্গেল লাভ স্টোরি' বলিউডে হলেও 'সিলসিলা' যেন হয়ে আছে একটি মাইলস্টোন। তবে আমরা 'খাইবার পাস' তো আর সেলুলয়েডের গল্প বলি না,আমরা বলি খাবারের কথা।যা খেলে শুধু পেট না, মনও ভড়ে। তবে আপনাদের যখন 'ত্রিকোন প্রেমের গল্প' দিয়েই পড়ানো শুরু করলাম,তাহলে আজকে নয় এটিই মুখ্য বিষয় হয়ে উঠুক। ভাবছেন খাবারের আবার "ত্রিকোন প্রেম"! হ্যাঁ, আজ সিলসিলা নয়, আপনাদের বলবো এর চেয়েও মুখরোচক একটি ত্রিকোন প্রেমের গল্পকাহিনী, যার নাম সিঙারা.......
আপনি যদি গুগল সার্চ করেন তাহলে সব জায়গায় একটা জিনিসই দেখায় সিঙারা 'বাংলাদেশের' খাবার এবং এর জন্মও ওই দেশে।কিন্তু আদতে এর জন্ম কিন্তু বাংলাদেশ বা ভারতবর্ষে নয়,এর উত্স ফরাসী শব্দ সংবোসাগ থেকে। সেই 'সংবোসাগ'ই হিন্দিভাষীদের কাছে সামোসা, বা সামুচা আবার বাংলা ও বাঙালিদের কাছে পরিচিত সিঙারা।
এই খাবারটির উত্পত্তি মধ্য এশিয়া ও মধ্য প্রাচ্যেই বলে মনে করা হয়।সেখান থেকে দক্ষিন পূর্ব এশিয়া,দক্ষিন এশিয়া হয়ে ধীরে ধীরে বহু জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।মধ্য প্রাচ্যের তুর্কীদের কাছে একটি প্রিয় মুখরোচক খাবার ছিল এই সামুচা বা সামোসা।পরে ভারতীয় উপমহাদেশে তুর্কী আগ্রাসনের পরে এটি ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বলে অনুমান করা হয়।
আবার অনেকে বলেন,ত্রয়োদশ বা চতুর্দশ শতকে ভারত উপমহাদেশে একে একে ব্যবসার উদ্দেশ্য আসেন মধ্যপ্রাচ্যের বনিকরা।তারা যেখানে থাকতেন,সেখানকার রান্নার লোকেরা তাদের জন্য সন্ধ্যাকালীন আহারের জন্য বানিয়ে দিতেন সামোসা,যা এভাবে বনিকদের মধ্য দিয়ে সারা ভারত উপমহাদেশ জুড়ে একটি মুখরোচক খাবার হিসেবে জায়গা দখল করে নেয়।
আপনি কি জানেন, প্রাচীন ইতিহাসের বিখ্যাত পর্যটক,লেখকদের লেখায় এই সিঙারার উল্লেখ আছে।অবাক হচ্ছেন? আসুন একটু জেনে নিন,আপনার পাড়ার মোড়ের দোকানে তৈরি হওয়া সামান্য টাকায় পাওয়া এই জলখাবারের কত অসামান্য মহিমা!
সিঙারা,বা আসলে সামোসা,এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ইরানি ঐতিহাসিক আবল ফজল বেহাকির লেখা ‘তারিখ-এ-বেহাগি’ নামের বইয়ে। সেই বই থেকে জানা যায়, সেগুলি আকারে বেশ ছোট ছোট হত,যাকে ডাকা হত 'সাম্বোসা' বলে। কারণ, সেই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটক ও বনিকরা ঘোড়া বা উটের পিঠে করে ঘুরত।তাদের খিদে পেলে তারা তাদের ছোট ছোট ঝোলা থেকে বের করতো এই সাম্বোসা গুলো,যার আয়তন ছোট হওয়ায় এগুলো ঝোলায় নিয়ে ঘুরতে সুবিধা হত।
আবার দিল্লি সুলতানি যুগেও যে ভারতে এই খাবারটির ব্যাপক চল ছিল তা জানা যায় ততকালীন সুলতানি যুগের রাজকবি 'হিন্দুস্হানের তোতাপাখি' আমির খসরুর লেখা বই থেকে।যেখানে তিনি লিখেছেন 'রাজকুমারগণ ও অাভিজাত্যরা মাংস,ঘি,পেয়াঁজ সহযোগে প্রস্তুত সামোসা উপভোগ করতেন'।
এছাড়া মরোক্কো থেকে আগত পর্যটক ইবন বতুতার লেখাতেও সিঙারার উল্লেখ মেলে,যার নাম তখন ছিল 'সম্বুসক',জানা যায় যার ভেতরে থাকতো পেস্তা, আখরোট ও মাংসের পুর। আবার এও জানা যায়, দিল্লির তদানিন্তন পাগলা রাজা 'মহম্মদ বিন তুঘলকের খুব প্রিয় ছিল এই সিঙারা,যা তার রাজদরবারে রয়্যাল স্ন্যাক্সেরও নাকি মর্যাদা পেত। আবার মোঘল আমলেও যে এই স্ন্যাক্স এর চল ছিল তা জানা যায়, আকবরের সভাকবি আবুল ফজলের লেখা 'আইন-ই-আজবরি' গ্রন্হ থেকে।সেখানে তিনি জানান,আকবরের রাজত্বে এই স্ন্যাক্সটি 'সানবুসাহ' নামে পরিচিত ছিল যার ভেতরে মাংসের পুর থাকতো এবং নামী-দামী মশলা ব্যবহার করা হত।
তাহলে ভাবুন,অতি সামান্য এই খাদ্য দ্রব্যটির চাহিদা আজ থেকে নয়,হাজার হাজার বছর আগে থেকেই।শুধু নামেই যা ফাঁরাক! তবে শুধু ইতিহাস নয়,বিশ্বের যে সমস্ত দেশে এটি টিফিনের খাবার হিসেবে পাওয়া যায়, সব জায়গাতেই এটি ত্রিকোনাকৃতি হলেও একেক জায়গায় এর একেক রকম নাম। যেমন আরবের দেশ গুলোতে এটি সানবাস্সাজ, আফগানিস্তে সাম্বোসা, তুর্কীতে সাম্সা, পোর্তুগাল,মোজাম্বিকে চেমুকা, পাকিস্তানে 'সমসা'। বলতে গেলে বাংলা ও বাংলাদেশেই এটি কে সিঙারা' বলা হয়।
আসলে ভাষাবিদ্ দের মতে, সমভুজা>সম্ভোসা>সামোসা>সিভুসা>সিঁঙুরা(নদীয়ার কথ্য ভাষা)>সিঙারা --- এভাবেই নামের অপভ্রংশের ফলে সিঙারা নামটি বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। তবে বাংলায় সিঙারা ছড়িয়ে পড়ার পেছনে একটা মজার গল্প শোনা যায়।সেটিই একটু আলোকপাত করি বরং।
এক মত অনুযায়ী,মনে করা হয় বাংলায় প্রথম সিঙারার প্রচলন শুরু প্রায় ১৭০০ এর দশকে,নদীয়া জেলায়,রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায়ের হাত ধরেই,থুরি মুখ ধরে!
একদিন রাজাকে তার পাচক গিরিধারি লুচি খেতে দিলে,রাজা রাজসভায় অন্যদের সাথে আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত থাকতে থাকতে বারবার লুচি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল।গিরিধারি তখন, রাজার খাবারের জন্য মিষ্টি পাঠান,কিন্তু রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায় ছিলেন মধুমেহ রুগি,মিষ্টি খাওয়া ছিল সম্পূর্ণ বারন।তাঁর পাচক জেনে বুঝে এই ভুল করলেন কী করে,এই নিয়ে রাজা হয়ে উঠলেন অগ্নিশর্মা।একেই লুচি ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায় রাজার ক্ষুধানিবারন হয় নি,তার উপর তার শরীরের জন্য যম মিষ্টি দেখে রাজা ক্ষেপে গিয়ে গিরিধারিকে রাজদরবার থেকে বের করে দেবার নিদান দিলেন।
এই কথা শুনে পাচকের স্ত্রী ধরিত্রি বেহারা কান্নায় ভেঙে পড়লেন এবং রাজার কাছে তখনই দেখা করে একটি শেষ সুযোগ চাইলেন।রাজাও তাকে সামান্য সময় দিয়ে বললেন তাঁর জন্য গরম গরম কোনো খাবার নিয়ে আসতে,রাজা যদি সেটা খেয়ে খুঁশি হন তবেই তিনি তার দেওয়া রায় ফিরিয়ে নেবেন।এই শুনে ধরিত্রি দেবী দৌঁড়লেন রন্ধনশালায়,কিন্তু গিয়ে পড়লেন ফাঁপরে।একেই অল্প সময়,তার উপর গরমগরম খাবার বানানো।সময় নষ্ট না করে ছোটো ছোটো করে ময়দা দিয়ে লুচি বেললেন,এবং আলাদা করে তরকারি না বানিয়ে সেই বেলে রাখা লুচি গুলোকে তিন কোনা করে ভাজ করে তার মধ্যে আগে থেকে বানিয়ে রাখা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া তরকারি একটু তেল ও মশলা সহযোগে পুর আকারে দিয়ে দিলেন।তারপর ছোট আকারের পুর ভর্তি লুচি গুলোকে ছেড়ে দিলেন কড়াইয়ে গরম ঘি তে। হাল্কা সোনালী রঙের হলে সেগুলো গরম গরম নামিয়ে পরিবেশন করতে গেলেন রাজা কৃষ্ণ চন্দ্রকে।
শোনা যায়,রাজা এই খাবারটি খেয়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি ধরিত্রি দেবীকে তো সোনার হার উপহার দিলেনই,সেই সংগে এটি গোটা নদীয়া সহ বাংলায় ছড়িয়ে পড়লো। সামোসার মত হওয়ায় পরে এটিই অপভ্রংশ হয়ে নদীয়ার কথ্যভাষা অনুযায়ী হয়ে উঠলো 'সিঁঙুরা' যা থেকে 'সিঙারা'।
এও জানা যায়,রাজার দরবারে সকলে এই সিঙারার প্রেমে পড়ে যায়।প্রতিদিন সন্ধ্যায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি রামপ্রসাদ এক থালা ভর্তি সিঙারা নিয়ে বসতেন খেতে। আবার,রাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের সময়ে দোলপূর্ণিমাতেও এই সিঙারা জড়িয়ে আছে।একবার বিখ্যাত ব্যবসায়ী ঊর্মিচাঁদের কাছে রাজা ২২টি হস্তি করে বাইশোটি সিঙারা ভেট হিসেবে পাঠিয়েছিল,এই ছিল সিঙারার প্রতি রাজার ভালোবাসা। অন্যদিকে, কৃষ্ণ চন্দ্র রায়ের সৌজন্যেই সিঙারার সাথে পরিচয় হয় রবার্ট ক্লাইভেরও। এভাবেই,বাংলায় সিঙারার আবিষ্কারে রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায়ের নাম ছড়িয়ে পরে,আর আঁড়ালে চলে যায় ধরিত্রি দেবীর নাম।
তাহলে,এই লেখার শুরুতে ভাবতে পেরেছিলেন একটা নিছক সিঙারার পেছনে এত গল্প!! জায়গাভেদে এটির স্বাদে হরেকরকম ভিন্নতা থাকলেও, সিঙারা হোক বা সামোসা সবই 'ত্রিকোনাকৃতির' এক জলখাবার, যার নাম শুনলেই অম্বলকে সম্বল করে বাঁচা পেটরোগা বাঙালিরও জীভে জল আসতে বাধ্য,আর সাথে যদি একটু গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চা আর মুড়ি থাকে, আহা!এই ছোট্ট খাবারটি কিভাবে যে আপনার সুন্দর স্বর্নালী সন্ধ্যাকে এক বন্ধনে এমন ভাবে জড়িয়ে দেবে যা আপনি ভাবতেও পারবেন না।
Bha osadharon
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুন👍
উত্তরমুছুন🥰
মুছুনআরে বাহ্
উত্তরমুছুনসামোসা ,সিঙ্গারা 😋
কিয়া জাদু দিখায়া😍❤️
তোমার লেখা না পড়লে ,,,
কিছু একটা miss থেকে যায়😌🤟
আরেহ ধন্যবাদ
মুছুনলেখাটা দারুণ হয়েছে কিন্তু দুঃখের কথা হলো রিসেন্টলি সোমালিয়া তে সিঙ্গরাকে নিষিদ্ধ খাদ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে
উত্তরমুছুনজানা ছিল না,জানলাম।ধন্যবাদ
মুছুনকত কিছু জানা হলো! 😍
উত্তরমুছুনজানার কোনো শেষ নাই,খাইবারপাস আছে তাই।
মুছুনAsadharon laglo post ta
উত্তরমুছুন🥰
মুছুনAbr notun kore singara prem pore galam.
উত্তরমুছুন🥰
মুছুনSera
উত্তরমুছুন❤️
মুছুনDarun laglo.
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনসিঙ্গাড়া খেতে খেতে পড়লাম।সুন্দর...
উত্তরমুছুনবাহঃ এটা বেশ ভালো ব্যাপার।
মুছুননতুন আরও একটা গল্প জানতে পারলাম❣️
উত্তরমুছুন🥰
মুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন